১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই আইনটির মাধ্যমে
ইংরেজদের সমাপ্তি এবং ভারত উপমহাদেশে নতুন রাজনৈতিক সূচনা হয়। এ আইনটি ১৯৪৭
সালের ৪ জুলাই কমন সভায় পাস হয়।
এবং ১৯৪৭ সালের ১৫ জুলাই লর্ড সভায় পাস হয়। সর্বশেষে ১৯৪৭ সালের ১৮ই জুলাই
রাজকের সম্মতিউর মাধ্যমে বিলটি আইনে পরিণত হয়। এই আইনটির মাধ্যমে ভারত ও
পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
পেজ সূচিপত্রঃ ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন
- ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন
- ভারত স্বাধীনতা আইনে আগস্ট প্রস্তাব
- ভারত স্বাধীনতা আইনে ক্রিপস প্রস্তাব
- ভারত স্বাধীনতা আইনে ওয়াভেল পরিকল্পনা
- ভারত স্বাধীনতা আইনে মন্ত্রীমিশন পরিকল্পনা
- ভারত স্বাধীনতা আইনে মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা
- ভারত স্বাধীনতা আইনের ধারা সমূহ
- ভারত স্বাধীনতা আইনের ফলাফল
- ভারত স্বাধীনতা আইনের গুরুত্ব
- মন্তব্যঃ ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন
তৎকালীন সময়ে ভারতীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি সম্প্রদায় ছিল কনগ্রেস ও
মুসলিম লীগ। ভারতীয়দের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংশ্লিষ্ট করার জন্য এই দুটি বড়
সম্প্রদায় কে ব্রিটিশ সরকার তাদের পক্ষে টানার জন্য নানারকম প্রস্তাব দেয়।
আরও পড়ুনঃ ফিলিস্তিন নিয়ে কিছু কথা
আগস্ট প্রস্তাব, মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব, ক্রিপ্স প্রস্তাব সহ নানা রকম
প্রস্তাব এই দুটি দলকে দেওয়া হয়। সবগুলো প্রস্তাবের মধ্যে শুধু মাউন্টব্যাটেন
পরিকল্পনা প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়। যার ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা
আইনটি প্রণীত হয়।
ভারত স্বাধীনতা আইনে আগস্ট প্রস্তাব
আগস্ট প্রস্তাবটি ১৯৪০ সালের ৮ই আগস্ট ব্রিটিশ সরকার প্রদান করে। প্রস্তাবটি
ছিল মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয়দের তাদের পক্ষে আনার জন্য। এই
প্রস্তাবটিতে বলা হয় ব্রিটিশ সরকারের লক্ষ্য হলো ভারতকে ডমিনোওনের মর্যাদা
দেওয়া।
এই যুদ্ধের শেষে সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব ভারতীয়দের হাতে ন্যস্ত
করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় আগস্ট প্রস্তাবের মাধ্যমে।এবং এই সংবিধান
প্রণয়নের সময় সংখ্যালঘুদের মতামতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হবে বলেও প্রস্তাব
দেওয়া হয়।
সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি সমন্বয়ে বড়লাটের শাসন দায়িত্ব
সম্প্রসারণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এবং আগস্ট প্রস্তাবে সর্বশেষ বলা হয় সকল
রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নিয়ে বড়লাট একটি যুদ্ধ উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবেন।
কিন্তু কংগ্রেস এটির বিরোধিতা করে এবং এটি প্রত্যাখ্যান করে।এবং মুসলিম লীগ এটি
গ্রহণ বা বর্জন কোনটি করে না বরং ভারত বিভক্তি ও মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমির
দাবি জানায়।
ভারত স্বাধীনতা আইনে ক্রিপস প্রস্তাব
তৎকালীন ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী ছিলেন স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস। তিনি
১৯৪২ সালে ভারতীয়দের সঙ্গে আলোচনার জন্য কয়েকটি প্রস্তাব নিয়ে আসেন যেটি
ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস প্রস্তাবটি প্রণয়ন করা হয় ১৯৪২ সালের ৩০
মার্চ।
ক্রিপস প্রস্তাবে বলা হয় ভারত ইউনিয়ন ডোমিনিনের মর্যাদা পাবে এবং
অন্যান্য ডোমিনিয়নের সমকক্ষ হবে। আরো বলা হয় ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্রীয়
ইউনিয়ন হবে এবং যুদ্ধের শেষে ব্রিটিশ সরকার ভারতের নতুন সংবিধান প্রণয়নের
জন্য একটি গণপরিষদ গঠন করবে।
এ প্রস্তাবে বলা হয় ব্রিটিশ সরকার ও গণপরিষদ একমত
না হলে সংখ্যালঘুদের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না। এবং ভারত ইউনিয়নের
জন্য সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদ ও ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে একটি
চুক্তি সম্পাদিত হবে। এই প্রস্তাবটি ও কনগ্রেস ও মুসলিম লীগ প্রত্যাখ্যান
করে।
ভারত স্বাধীনতা আইনে ওয়াভেল পরিকল্পনা
১৯৪৫ সালের ১৪ জুন ব্রিটিশ সরকার বড়লাট লর্ড ওয়াভেল এর মাধ্যমে ভারতীয়
দুইটি দল কনগ্রেস ও মুসলিম লীগের কাছে একটি পরিকল্পনা পেশ করে যেটিকে বলা হয়
ওয়াভেল পরিকল্পনা। ওয়াভেল পরিকল্পনায় বলা হয় খুব দ্রুত এই ব্রিটিশ সরকার
ক্ষমতা হস্তান্তর ও সংবিধান রচনায় কাজ শুরু করবে।
এবং নতুন সংবিধান রচিত না
হওয়া পর্যন্ত ভারতীয়দের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে।এ প্রস্তাবে
আরো বলা হয় বড়লাটের কার্যনির্বাবাহক সীমিত পুনর্গঠন হবে এবং তাতে একমাত্র
বড়লাট ও প্রধান সেনাপতি ব্যতীত সকল সদস্যে ভারতীয় হবেন।
এবং শাসন পরিষদে
হিন্দু ও মুসলমান সদস্যের সংখ্যা সমান হবে। ভারতীয়দের প্রতিরক্ষা দায়িত্ব
যতদিন ব্রিটিশ সরকারের হাতের ন্যস্ত থাকবে ততদিন সামরিক দপ্তর ও ব্রিটিশ
সরকারের কাছে থাকবে। কনগ্রেস এ প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে যার কারনে ওয়াভেল
পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
ভারত স্বাধীনতা আইনে মন্ত্রীমিশন পরিকল্পনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের পূর্ব প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ভারতীয়দের ক্ষমতা
হস্তান্তরকে ত্বরান্বিত করতে ব্রিটিশ সরকার লর্ডপ্যাথিক লরেন্সের নেতৃত্বে
তিনজন সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দলকে ভারতে পাঠায়। তাদেরকে প্রেরণ করা হয়
১৯৪৬ সালে জানুয়ারি মাসে।
এ প্রস্তাবটি কে বলা হয় মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা। এ
প্রস্তাবে বলা হয় কেন্দ্রে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।এবং
ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যপাল নিয়ে একটি সাহিত্য শাসিত ভারতীয় ইউনিয়ন গঠন
করা হবে।এ প্রস্তাবে আরো বলা হয় মিশন তিন ভাবে প্রদেশগুলোকে বিভক্ত করে
হিন্দু প্রধান,
মুসলিম প্রধান ও বাংলা এবং আসাম গ্রুপের গঠিত হবে। এবং বলা হয়
ভারতীয় ইউনিয়ন গঠিত হওয়ার পর দেশীয় রাজ্যগুলোর ওপর রাজকীয় সার্বভৌমত্বের
অবসান ঘটবে। মুসলিম লীগ মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও কনগ্রেস
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন পরিকল্পনা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে যার ফলে এ
প্রস্তাবটিও গৃহীত হয় না।
ভারত স্বাধীনতা আইনে মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা
১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা প্রস্তাবটি দেওয়া হয়। দায়িত্বভার
গ্রহণ করেই মাউন্টব্যাটেন ঘোষণা করেন ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৮ সালের জুন মাসের
মধ্যেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা তে বলা হয় ১৯৪৭ সালের
১৫ আগস্ট স্বাধীন হলে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র গঠিত হবে।
বাংলা
পাঞ্জাব প্রদেশের জেলা গুলো ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হবে এবং উত্তর-পশ্চিম
সীমান্ত প্রদেশ বেলুচিস্তান ও আসামের সিলেট জেলা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেবে
কিনা তা গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। ভারত ও পাকিস্তান কমনওয়েলথ ভুক্ত
থাকবে কিনা তা উভয় দেশের গণপরিষদ সিদ্ধান্ত নেবে।
এ প্রস্তাবে আরো বলা হয়
ভারতকে ডোমিনিয়নের মর্যাদা প্রদানের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি
সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা হবে।এবং ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণের
জন্য একটি আইন কমিশন গঠিত হবে। এ প্রস্তাবটি কনগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় দল
গ্রহণ করে এবং এর ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইনটি প্রণীত হয়।
ভারত স্বাধীনতা আইনের ধারা সমূহ
ভারত স্বাধীনতা আইনের ধারা সমূহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে একটি পর্যায়ে
শুরু আরেকটি পর্যায়ে সমাপ্তি ঘটে। যথাক্রমে ধারা সমূহ হলো-
১.ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ও ডোমিনিয়ন।
২.বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্তিকরণ।
৩.ডোমিনিয়ন গণপরিষদ গঠন।
৪.ডোমিনিয়নের পরিধি ও সীমানা।
৫.গভর্নর জেনারেল নিয়োগ।
৬.কমনওয়েল তে থাকা না থাকার স্বাধীনতা।
৭.ভারত সচিবের পথ বিলুপ্ত ঘোষণা।
৮.দেশীয় রাজ্যের উপর থেকে ব্রিটিশ কর্তৃত্বের অবসান।
৯.গভর্নর নিয়োগ।
১০.গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরের ক্ষমতার সীমিত।
১১.আইন কার্যকরের সময়সীমা।
১২.ব্রিটিশ রাজার ভারত সম্রাট উপাধি বিলোপ।
২.বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্তিকরণ।
৩.ডোমিনিয়ন গণপরিষদ গঠন।
৪.ডোমিনিয়নের পরিধি ও সীমানা।
৫.গভর্নর জেনারেল নিয়োগ।
৬.কমনওয়েল তে থাকা না থাকার স্বাধীনতা।
৭.ভারত সচিবের পথ বিলুপ্ত ঘোষণা।
৮.দেশীয় রাজ্যের উপর থেকে ব্রিটিশ কর্তৃত্বের অবসান।
৯.গভর্নর নিয়োগ।
১০.গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরের ক্ষমতার সীমিত।
১১.আইন কার্যকরের সময়সীমা।
১২.ব্রিটিশ রাজার ভারত সম্রাট উপাধি বিলোপ।
ভারত স্বাধীনতা আইনের এই বারটি ধারা ছিল।
ভারত স্বাধীনতা আইনের ফলাফল
ভারত স্বাধীনতা আইন-প্রকাশের পর কনগ্রেস এর বিরোধিতা করলেও ১৯৪৬ থেকে ৪৭ এর
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, নির্বাচনের ফল এবং মুসলিম লীগের আপসহীন মনোভাবের কারণে
কংগ্রেস ভারত বিভক্তিই মেনে নেয়। মুসলিম লীগ এর মাধ্যমে দলের দাবি বাস্তবায়ন
হয় বলে এটি বেছে নেয়।
ভারতের গভর্নর জেনারেল হন লর্ড মাউন্টব্যাটেন এবং
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন
জওহরলাল নেহেরু। এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলি খান। এবং ১৯০
বছর পর ভারত স্বাধীন হয়। যার ফলে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন
রাষ্ট্রের অভ্যুত্থান ঘটে।
ভারত স্বাধীনতা আইনের গুরুত্ব
ভারত উপমহাদেশের শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতির ইতিহাসে ভারত স্বাধীনতা আইন একটি
গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে পরিচিত। এর মাধ্যমে দীর্ঘ ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের
অবসান ঘটে। পরিশেষে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের
জন্ম হয়। এবং ভারত বর্ষ তার স্বাধীনতা ফিরে পায়।
মন্তব্যঃ ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের ধারা রয়েছে ১২ টি। এই বারটি ধারা তৎকালীন
ভারতীয়দের জন্য মুক্তির সনদ হিসেবে গণ্য করলে ভুল হবে না। কেননা এই বারটি
ধারার প্রতিটি ছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভারতীয়দের পক্ষে। ১৯৪৭ সালের ভারত
স্বাধীনতা আইন টি ভারত স্বাধীনতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্রিটিশদের
অবসানের অন্যতম গুরুত্ব রাখে এই ভারত স্বাধীনতা আইন।
আমিন একটিভ নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url